শ্রী শ্রী শ্যামচাঁদ জিউ মন্দির
নদিয়ার শান্তিপুরের বড়বাজারের শ্যামচাঁদ পাড়ায় অবস্থিত পাঁচ খিলানবিশিষ্ট, অলিন্দযুক্ত, দক্ষিণমুখী, বাংলা আটচালা শ্রেণীর শ্যামচাঁদ মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের এ শ্রেণীর বৃহতম মন্দিরগুলির অন্যতম।
উঁচু ভিতের উপর নির্মিত এ মন্দিরের দৈর্ঘ্য, প্রস্ত, ও উচ্চতা যথাক্রমে ৫২ ফুট ( ১৫.৮ মি. ), ৩৬ ফুট ( ১১ মি. ) ও আনুমানিক ৭০ ফুট ( ২১.৩ মি. )।
শান্তিপুর কুঠিরপাড়া নিবাসী তন্তুবায় বংশীয় গোবিন্দ দাস খাঁ অদ্বৈত প্রভুর সঙ্গে শ্রীহট্ট থেকে শান্তিপুরে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এই বংশের রামগোপাল খাঁ চৌধুরী ১৬৪৮ শকাব্দে শ্যামচাঁদ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। খাঁ চৌধুরীরা চার ভাই রামগোপাল, রামজীবন, রামচরণ ও রামভদ্র এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বিগ্রহের পাদ-পদ্মাসনে উক্ত চার জনেরই নাম খোদিত আছে। মন্দিরের সামনের পশ্চিম দিকের খিলানের নিচে নিবদ্ধ পাথরের প্রতিষ্ঠা-ফলকের পাঠ নিম্নরূপ :
" শ্রীমতঃ শ্যামচন্দ্রস্য মন্দিরং পূর্ণতামিয়াত্ ।
বসুবেদার্ত্তুশুভ্রাংশু সংখ্যয়া গণিতে শকে ।। ১৬৪৮ "
অর্থাৎ, ১৬৪৮ শকে ( ১৭২৬ খ্রীষ্টাব্দে ) শ্যামচাঁদের মন্দির সম্পূর্ণ হল। বসু = ৮, বেদ = ৪, ঋতু = ৬, শুভ্রাংশু = ১ ধরে অঙ্কের বামা গতি নিয়মানুসারে প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৪৮ শকাব্দ।
মন্দিরটির টেরাকোটা-সজ্জা যৎসামান্য। খিলানগুলির উপরের চারিদিকে বাংলা আটচালা শ্রেণীর প্রতীক শিবালয় এবং তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। উপরের কার্নিসের নিচে দুই প্রস্থে পোড়ামাটির ফুল এবং দু পাশের উপরে-নিচেও একই রকমের ফুল মন্দিরটির অঙ্গ সজ্জারূপে বিন্যস্ত হয়েছে। খিলানগুলির উপরের প্রস্থে পঙ্খের কাজ ছাড়া কোন পোড়ামাটির কাজ নেই। শ্যামচাঁদের এই মন্দিরটির অবস্থা এখনও বেশ ভাল। মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজার কাঠের কাজও খুব সুন্দর। যদিও অযত্নে ও রঙের প্রলেপে তা অনেকটাই ম্লান।
এই মন্দিরটির পাঁচটি 'চূড়া'। 'চূড়া' অর্থে এখানে 'রত্ন' বা 'শিখর' নয়। কলস, আমলক ( আমলকি ফলের মত চারিদিকে শলাকার মত খাঁজকাটা পাথরের বলয় ) ও চক্রের দ্বারা চূড়া নির্ধারিত হয়েছে।
মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে খাঁ'রা এখানে এক বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় যে বিরাট মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তাতে কাশী-কাঞ্চী-দ্রাবিড়-মথুরা, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ প্রভৃতি স্থান থেকে পণ্ডিতমণ্ডলী আহূত হন । মন্দির নির্মাণে ব্যয় হয় আনুমানিক তৎকালীন দু লক্ষ টাকা এবং আনুমানিক এক লক্ষ মুদ্রা নজরানা নিয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা নদিয়ারাজ রঘুরাম রায় সভাগৃহের প্রধানতম স্থানে উপবেসন করেন।
শ্যামচাঁদের মূর্তিটি কষ্টিপাথরে নির্মিত। আদি রাধিকা মূর্তিটি ছিল স্বর্ণ নির্মিত। এখানে উল্লেখ্য, সেই সময়ের সমাজ রানি রাসমণির মত রামগোপালকেও নিজের নামে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে দেয় নি। শ্রী শ্রী শ্যামচাঁদ বিগ্রহ নদিয়ারাজের নামে এবং রাধিকা বিগ্রহ গুরু রাধাবল্লভ গোস্বামীর ( উড়িয়া গোস্বামী বাড়ির আদি পুরুষ ) নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সময় যে সমস্ত ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ আগমণ করেন তারমধ্যে গুপ্তিপাড়ার শ্রী শ্রী বৃন্দাবন চন্দ্র মঠের শ্রীপাদ সমকানন্দ পণ্ডিতমণ্ডলীসহ উপস্থিত ছিলেন।
শ্রী শ্রী শ্যামচাঁদ বিগ্রহ প্রতিদিন পূজিত হন। খাঁচৌধুরীদের পারিবারিক বিগ্রহ রাধাকান্তও এখানে উপাসিত। মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকতে বাঁ দিকে একটি ছোট মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ এবং অপর একটি ছোট মন্দিরে শ্রীগৌরাঙ্গ, শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীঅদ্বৈতের মূর্তি আছে। মন্দিরের ডান দিকে একটি ছোট্ট ঘরে মাধবেন্দ্রপুরীর মূর্তি আছে। মন্দিরের সামনে একটি বড় নাটমন্দির আছে। মন্দির প্রাঙ্গণ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।
১৩৫৭ বঙ্গাব্দে শান্তিপুরের সাহেব পাড়ার শ্রীমতী হরিমতি দাসী শ্যামচাঁদের সাবেক সিংহাসনটির সংস্কার ও ধাতুমণ্ডিত করে দেন।
বর্তমানে 'শ্রী শ্রী রাধাশ্যামচাঁদ মন্দির পরিচালন কমিটি' কর্তৃক বিগ্রহের সেবাকার্য পরিচালনা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মন্দিরটি সংরক্ষিত। মন্দিরটি সকাল ৬ টা ৩০ মিনিটে খোলে এবং রাত্রি ৮ টা ৩০ মিনিটে বন্ধ হয়। নিত্যভোগের সময় দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিট। দক্ষিণার বিনিময়ে অন্নভোগের রসিদ সংগ্রহের সময় ৮ টা ৩০ মিনিট থেকে ৯ টা ৩০ মিনিট।
রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে এই মন্দিরে চার দিন ব্যাপী ভক্তবৃন্দ দ্বারা হরিনাম সংকীর্তন হয় কিন্তু ভাঙ্গারাসের শোভাযাত্রায় এই বিগ্রহ অংশ নেন না। দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে শ্যামচাঁদ জিউ নগর ভ্রমণে বেরিয়ে গুরু-গৃহ উড়িয়া গোস্বামী বাড়ি যান এবং 'ডালিধরা' অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
------------------------------------------------------------------------------------------------
Post a Comment